বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে অপ্রতিরোধ্যভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তাদের এই দীর্ঘমেয়াদি প্রাধান্যের মূলে ছিল বিরোধী দলগুলোর দুর্বলতা, উন্নয়নমূলক কাজের ধারাবাহিকতা এবং সরকারের শক্তিশালী অবস্থান। তবে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে যাওয়া একটি শিক্ষার্থী আন্দোলন সরকারের ক্ষমতা এবং স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নাটকীয় প্রস্থান এবং তার সাজানো সাম্রাজ্যের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হয়।
আন্দোলনের সূত্রপাত
২০২৪ সালের মার্চ মাসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার অভাব, শিক্ষার মানের অবনতি এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের জন্ম দেয়। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ, কিন্তু দ্রুতই তা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো ছিল:
- শিক্ষার মান উন্নয়ন: শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে যে, সরকারের অবহেলার কারণে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নগামী।
- ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে সংঘটিত বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় নিরাপত্তার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
- প্রশাসনিক দুর্নীতি বন্ধ: তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানায়।
- গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা: তারা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার দাবি তোলে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
আন্দোলনের প্রথম দিকেই শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিপরিষদ এটি একটি নিয়ন্ত্রণহীন আন্দোলন হিসেবে দেখতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে আন্দোলনকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু যখন আন্দোলনকারীরা আরও সংগঠিত এবং শক্তিশালী হতে থাকে, তখন সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে।
- পুলিশের কঠোর ব্যবস্থা: আন্দোলন দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এবং র্যাব সদস্যদের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, এবং রাবার বুলেটের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়।
- গ্রেফতার ও সহিংসতা: সরকারের নির্দেশে বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করা হয়, এবং অনেক শিক্ষার্থী নিখোঁজও হয়। এই সহিংসতা আন্দোলনকে আরও উস্কে দেয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
- মিডিয়া সেন্সর: সরকার আন্দোলনের খবর প্রচারে বাধা দিতে চেষ্টা করে এবং কিছু মিডিয়া হাউসের উপর চাপ সৃষ্টি করে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে আন্দোলনের খবর সারা দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের বিস্তার
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দ্রুতই ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনা এবং অন্যান্য শহরের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনকারীরা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান ধর্মঘট, র্যালি এবং মিছিল আয়োজন করে।
- বিচ্ছিন্নতা ও একতা: আন্দোলনকারীরা দলীয় বিভাজন ভুলে গিয়ে এক হয়ে যায়। বামপন্থী, ডানপন্থী, এবং মধ্যপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে।
- সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ: শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধও ব্যবহার করে। তারা পথনাটক, কবিতা, এবং গানের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করে এবং জনগণের সমর্থন আদায় করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্দোলন যখন বিস্তৃত আকার ধারণ করে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরও এই দিকে চলে আসে।
- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন: যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন শেখ হাসিনার সরকারের কঠোর নীতির সমালোচনা করে এবং শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। তারা সরকারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার পরামর্শ দেয়।
- জাতিসংঘ: জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানান এবং আন্দোলনকারীদের উপর হামলা বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
- আন্তর্জাতিক মিডিয়া: আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট
আন্দোলন যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন আওয়ামী লীগের ভেতরেও সংকটের সৃষ্টি হয়।
- দলের বিভক্তি: দলের অনেক সিনিয়র নেতা শেখ হাসিনার কঠোর নীতির সমালোচনা করেন। তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বান জানান। এই বিভক্তি দলের অভ্যন্তরে চাপ এবং সংকট তৈরি করে।
- কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক: আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি জরুরি বৈঠক ডাকা হয় যেখানে দলের ভবিষ্যত কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে, শেখ হাসিনার প্রতি দলের নেতাদের আস্থার অভাব এবং তাদের বিভিন্ন মতবিরোধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
- নেতৃত্ব সংকট: শেখ হাসিনা দলকে একত্রিত করতে ব্যর্থ হন এবং নেতৃত্বের উপর তার নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। দলের ভেতরে নতুন নেতৃত্বের দাবি উঠতে থাকে।
শেখ হাসিনার নাটকীয় প্রস্থান
আন্দোলনের ৩৫তম দিনে, শিক্ষার্থীরা ঢাকায় বিশাল এক সমাবেশ আয়োজন করে যেখানে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তোলে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ এই সমাবেশে যোগ দেয়, যা সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
- আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়: পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সরকারের ভেতরে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। সেনাবাহিনীর কিছু অংশও সরকারের কঠোর নীতির সমালোচনা করে।
- গোপন বৈঠক: শেখ হাসিনা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সাথে গোপনে বৈঠক করেন এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি সাময়িকভাবে দেশত্যাগ করবেন।
- দেশত্যাগ: ৩৬তম দিনে, গভীর রাতে শেখ হাসিনা একটি বিশেষ বিমানে করে দেশের বাইরে পাড়ি জমান। তার এই প্রস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
প্রস্থানের পরের পরিণতি
শেখ হাসিনার প্রস্থান বাংলাদেশে একটি বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে।
- অস্থায়ী সরকার: সেনাবাহিনীর সহায়তায় একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়, যা দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। তবে, নতুন সরকারকেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত: শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে। দলের নেতৃত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং অনেকেই দল থেকে পদত্যাগ করে।
- নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান: পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি উত্থান ঘটে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গঠিত একটি নতুন রাজনৈতিক জোট দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং জনগণের সমর্থন আদায় করে।
উপসংহার : শেখ হাসিনার নাটকীয় প্রস্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ৩৬ দিনের এই আন্দোলন শুধু শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের দম্ভকে চূর্ণ করেনি, বরং দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনরুত্থান এবং নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান নিয়ে দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে। এই ঘটনা বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন